হাইব্রিড মাগুর মাছের চাষ

পরিচিতি
মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাগুর মাছের চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মাগুর একটি দামী মাছ হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য মাছের তুলনায় মাগুর মাছ অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং এই মাছের যথেষ্ট বাজার চাহিদাও রয়েছে। ছোট বড় যেকোন ধরনের জলাশয়েই এই মাছ চাষ করা যায়। মাগুর বলতে আমরা আমাদের দেশীয় মাগুর মাছকেই বুঝে থাকি। দেশী মাগুর মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দেখতে খুবই আকর্ষণীয় কিন্তু আকারে ছোট এবং দৈহিক বৃদ্ধি কম হওয়ায় দেশী মাগুরের চাষ অর্থনৈতিক দিক থেকে জন সাধারণের কাছে তেমন সারা জাগাতে পারেনি। অন্যদিকে আফ্রিকান জাতের মাগুর দ্রুত বর্ধনশীল হলেও এর দৈহিক আকৃতি ও স্বাদের দিক থেকে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। এছাড়া এই মাছটি আমাদের জলজ পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। এমনতাবস্থায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিট্যুট কৌলিতাত্তিক গবেষণার মাধ্যমে দেশীয় জাতটির উন্নয়নকল্পে সংকরায়নের কাজ হাতে নেয় এবং দেশী জাতের স্ত্রী মাগুর এবং আফ্রিকান জাতের পুরুষ মাগুরের সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত জাতের সংকর মাগুর উদ্ভাবনে সক্ষম হয়। এই সংকর জাতটি দেশী মাগুরের মতই সুস্বাদু ও সুশ্রী, অন্যদিকে আফ্রিকান মাগুরের মত দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় মিঠাপানিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে হাইব্রিড মাগুর মাছের চাষ অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

*সুবিধাদি *
• অল্প জায়গায় অধিক ঘনত্বে চাষ করে স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।
• এই মাছ তুলনামূলকভাবে কম রাক্ষুসে স্বভাবের, খাদ্য চাহিদা কম এবং প্রকৃতিতে এরা বাচ্চাও দেয় না, ফলে জলজ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়।
• অন্যান্য জাতের মাছের সাথে মিশ্র চাষও করা সম্ভব।
• যেহেতু দেখতে দেশী মাগুরের মত আকর্ষণীয় ও সুশ্রী এবং সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফলে চাহিদা ও বাজার মূল্য অধিক।
• মিনি পুকুর, সিমেন্টের চৌবাচ্চা কিংবা নদী বা পুকুরে জালের খাচাঁয় সহজেই চাষ করা যায় এবং অন্যান্য মাছের তুলনায় অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।
• যে সব পরিবারের মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পুকুর নেই তাদের ঘরের পার্শ্বে বা আঙ্গিনায় মিনি পুকুর খনন করে বা সিমেন্টের চৌবাচ্চা তৈরি করে অথবা নদীতে জালের খাচাঁয় এই মাছ চাষ করে যেমন পরিবারের প্রোটিন ঘাটতি মেটানো যেতে পারে তেমনি পারিবারিক আয়ও বৃদ্ধি পেতে পারে।
মিনি পুকুরে চাষ
পুকুর তৈরি ১ থেকে ২ শতাংশ পুকুরকে মিনি পুকুর হিসেবে ধরা হয়। মিনি পুকুরের গভীরতা ১ মিটার হলে ভালো হয়। বন্যার পানিতে ডুবে যায় না এমন স্থানে পুকুর নির্বাচন করা ভালো। প্রথমেই সম্ভব হলে পুকুরের পানি শুকিয়ে ফেলতে হবে। অতঃপর পুকুরের পাড় মেরামত করে পুকুরে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ২/৩ দিন পর পুকুরে শতাংশ প্রতি ৫-১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম টি.এস.পি প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ৪ থেকে ৫ দিন পর পুকুরের পানির রং সবুজাভ হলে পুকুর মাছ মজুদের উপযোগী হয়েছে বলে ধরা হয়। মাছ মজুদ পুকুরের পানি মাছ ছাড়ার উপযোগী হলে ১০-১৫ গ্রাম ওজনের হাইব্রিড মাগুর এর পোনা ৫০০-১০০০টি শতাংশ প্রতি মজুদ করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগ মাছ মজুদের পর প্রাথমিক পর্যায়ে মজুদকৃত মাছের দেহের ওজনের ৫-৭% এবং পরবর্তীতে ৪-৫% হারে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য প্রতি ১৫ দিনে একবার কিছু মাছ ধরে ওজন নিতে হবে এবং মোট ওজনের শতকরা হিসেবে খাবার দিতে হবে। বিভিন্ন দেশীয় খাদ্য উপাদান থেকে তৈরি কৃত্রিম খাদ্য নাড়িভুঁড়ি, শামুক ঝিনুকের মাংস ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও সৌদি বাংলা ফিশ ফিড লিঃ এর তৈরি খাদ্য অথবা পূর্বে উল্লেখিত কৃত্রিম খাবারও তৈরি করে পুকুরে ব্যবহার করা যেতে পারে। মাছের পরিচর্যা মাছ মজুদের পর থেকেই প্রতি ১৫-২০ দিন পরপর জাল টেনে পুকুরের মাছের বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে কিনা, মাছের রোগ-ব্যাধি আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হঠাৎ করে ২/১টি মাছ বেশি বড় হয়ে গেলে পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। মাছ আহরণ পুকুরে মজুদ করার মাস তিনেক পর মাছ বাজারজাত করার উপযোগী সাইজ (১৫০-২০০ গ্রাম) হলে মাছ আহরণ করা যায়। তবে সব মাছ একই সাথে বিক্রয় না করে বড় মাছ গুলো প্রথমে বিক্রয় করলে ছোট মাছগুলো দ্রুত বড় হওয়ার সুযোগ পাবে এবং এতে ভালো ফল পাওয়া যায়। মাছের উৎপাদন সঠিক পরিচর্যা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে শতাংশ প্রতি ১০০-১৫০ কেজি পর্যন্ত মাছের উৎপাদন পাওয়া যেতে পারে।
জালের খাঁচায় চাষ
ভূমিকাঃ বড় আকারের পুকুর, খাল-বিল কিংবা নদীতে জালের তৈরি খাঁচায় হাইব্রিড মাগুর চাষ করা যায়। খাঁচায় মাছ চাষের জন্য নিজস্ব পুকুর না হলেও চলে। অধিকন্তু নদীর প্রবাহমান পানিতে খাঁচায় মাছ চাষ করলে তুলনামূলকভাবে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করা যায় এবং উৎপাদন বেশি পাওয়া যায়। খাঁচা তৈরি ও স্থাপন উন্নত মানের পলিইথিলিন নেট দ্বারা খাঁচা তৈরি করাই সবচেয়ে ভালো। এই জাল কাঁকড়ায় কাটে না এবং পানিতেও পচে না। দুই থেকে পাঁচ বর্গমিটার আকারের খাঁচা মাছ চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। বেশি বড় আকারের খাঁচার ব্যবস্থাপনা করা একটু কঠিন। খাঁচার উচ্চতা ১.৫ মিটার হলেই চলে এবং অন্ততঃ ১ মিটার পানির নীচে থাকবে। খাঁচা বাঁশের ফ্রেম দ্বারা এমনভাবে পানিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে যাতে মাটিতে লেগে না থাকে এবং পানির উপরেও কিছুটা ভেসে থাকে। খাঁচার উপরিভাগ পাতলা জাল দ্বারা এমনভাবে ঢেকে দিতে হবে যাতে মাছ লাফিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে। মাছ মজুদ ও খাদ্য প্রয়োগ জালের তৈরি খাঁচার প্রতি বর্গমিটারে ১০-১৫ গ্রাম ওজনের ৫০-১০০টি মাছ মজুদ করে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়। প্রাথমিক অবস্থায় মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের শতকরা ৫-৭ ভাগ হারে এবং পরবতীতে ৪-৫ ভাগ হারে খাবার দুই ভাগ করে দিনে দুইবারে প্রয়োগ করতে হবে। জালের খাঁচায়ও চৌবাচ্চার মত একই খাবার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। মাছ ঠিকমত খাবার খাচ্ছে কিনা কিংবা খাবার অতিরিক্ত থেকে যাচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বাঁশের তৈরি ঝুড়ি খাঁচায় ঝুলিয়ে খাবার প্রয়োগ করলে ভালো হয়। মাছ মজুদের পর থেকে প্রতি ১৫-২০ দিন পরপর খাঁচার কিছু মাছ ধরে ওজন নিয়ে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। খাঁচা রক্ষণাবেক্ষণ খাঁচা পানিতে ঝুলিয়ে দিয়ে মাছ চাষ করা হয় বিধায় শ্যাওলা বা অন্যান্য ময়লা জমে খাঁচার জালের ছিদ্র বা ফাঁস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে খাঁচায় পানির প্রবাহ সঠিক নাও থাকতে পারে এবং খাঁচার পানিতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে। তাই মাঝে মাঝে জালের খাঁচা পরিষ্কার করে দিতে হবে। মাছ আহরণ ও উৎপাদন খাঁচায় সঠিকভাবে খাবার প্রয়োগ করলে তিন মাসের মধ্যেই মজুদকৃত মাছ বাজারজাতের (১৫০-২০০ গ্রাম সাইজ) উপযোগী হয় এবং এই সময় মাছ আহরণ করা যেতে পারে। প্রতি বর্গ মিটার খাঁচা থেকে ৬-৮ কেজি মাছ পাওয়া যায়।
সিমেন্টের মিনি চৌবাচ্চায় হাইব্রিড মাগুর চাষ পদ্ধতি: ছোট আকারের সিমেন্টের চৌবাচ্চয় হাইব্রিড মাগুর সহজেই চাষ করা যায়। বিশেষতঃ শহর অঞ্চলে যেখানে মাছ চাষ করার মত কোন পুকুর নেই সেখানে বাড়ীর পাশের অব্যবহৃত চৌবাচ্চায় অথবা ছোট আকৃতির চৌবাচ্চা তৈরি করে তাতে মাগুর মাছের চাষ করা যেতে পারে। এর ফলে বাড়তি আয়ের সাথে সাথে পরিবারের আমিষের চাহিদা কিছুটা হলেও পুরণ করা সম্ভব হবে। চৌবাচ্চার আকার ও পানির গভীরতা মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত চৌবাচ্চার আকার কমপক্ষে ২ বর্গমিটার এবং গভীরতা কমপক্ষে ১ মিটার হলে ভালো হয়। পানির গভীরতা সবসময় কমপক্ষে ০.৮-০.৯ মিটার হলে ভালো হয়। মাছ মজুদ চৌবাচ্চা ৭৫-৯০ সে. মি. পর্যন্ত পানি দ্বারা পূর্ণ করে প্রতি বর্গমিটার ৪০টি ১০-১৫ গ্রাম ওজনের হাইব্রিড মাগুরের পোনা মজুদ করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগ মাছ মজুদের পর মাছের দেহের মোট ওজনের শতকরা ৫-৭ ভাগ হারে প্রথম ১৫ দিন এবং পরবর্তীতে শতকরা ৪-৫ ভাগ খাবার সমান দুই ভাগ করে চৌবাচ্চায় দিনে দুইবারে প্রয়োগ করতে হবে। খাদ্য হিসেবে গরু-ছাগলের রক্তের সাথে খৈল, কুঁড়া, ফিশমিল, ভিটামিন ইত্যাদি মিশিয়ে নিম্নে উল্লেখিত ফর্মুলা অনুযায়ী খাদ্য তৈরি করে মিনি চৌবাচ্চায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া রান্না ঘরের উচ্ছিষ্ট যেমন- হাঁস-মুরগীর ও মাছের নাড়ি-ভুঁড়ি অথবা শামুক-ঝিনুকের মাংস ছোট ছোট করে কেটে চৌবাচ্চায় প্রয়োগ করা যায়। তাছাড়া সম্ভব হলে গরু-ছাগলের নাড়ি-ভুঁড়ি সংগ্রহ করে সেগুলো ছোট ছোট করে কেটে দেয়া যেতে পারে।

উপাদান
পরিমাণ (%) ফিশ মিল ২.০% ব্লাড মিল ২২.৫% তিলের খৈল ২৩.০% চালের কুঁড়া ৪৩.০% ময়দা ৪.৫% ভিটামিন ০.৫% লবণ ১.৫% সয়াবিন তৈল ১.০% ঝিনুক চূর্ণ ২.০%
চৌবাচ্চা পরিষ্কার এবং পানি পরিবর্তন চৌবাচ্চায় খাদ্য প্রয়োগের পর লক্ষ্য রাখতে হবে সরবরাহকৃত খাবার মাছ পুরোপুরি খেয়ে ফেলছে কিনা। অতিরিক্ত খাদ্য জমা থাকলে তা পচে গিয়ে পানির গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলতে পারে। কাজেই অতিরিক্ত খাবার এবং অন্যান্য ময়লা সাইফোনিং করে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। এছাড়াও চৌবাচ্চার পানির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য প্রতি সপ্তাহে একবার চৌবাচ্চার পানি পরিবর্তন করতে হবে। মাছ আহরণ মিনি সিমেন্ট চৌবাচ্চায় তিন মাস চাষ করার পর মাছ বাজারজাত করার উপযোগী (১০৩-১৭৫ গ্রাম) হয় এবং এই সময় চৌবাচ্চার মাছ আহরণ করা যায়। উৎপাদন প্রতি ২ বর্গমিটার চৌবাচ্চায় ৯.০ কেজি থেকে ১১.০ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র ১. মাছ চাষ ম্যানুয়াল, মৎস্য অধিদপ্তর
SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment