পোনা মাছের বাচ্চা এবং চারা পোনার বাণিজ্যিক উপাদন



উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় জাতের যথেষ্ট পরিমাণে বীজের উপলভ্যতা মত্স্য চাষে সাফল্যের অন্যতম কারণ। যদিও গতকয়েক বছরে পোনা মাছের বাচ্চা তোলার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, উপযুক্ত আকারের বীজের প্রাপ্যতা এখনও একটা সমস্যা। আঁতুড়ে পালনকালে ৭২-৯৬ ঘন্টা বয়সের সদ্য খেতে শেখা বাচ্চাদের ১৫-২০ দিন রাখা হয়, যে সময়ের মধ্যে ওগুলো ২৫-৩০ মিমি লম্বা বাচ্চায় রূপান্তরিত হয়। এই মাছের বাচ্চাগুলো অন্য একটা পুকুরে ২-৩ মাস ধরে পালন করা হয় যাতে ওগুলিকে বড় করে প্রায় ১০০মিমি আকারের চারা তৈরি করা যায়।

আঁতুড় জলাশয় পরিচালন
০.০২ -০.১ হেক্টর মাপের ও ১.০-১.৫ মি. গভীরতা বিশিষ্ট জলাশয় আঁতুড়ের জন্য বাঞ্ছনীয় যদিও বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ০.৫ হেক্টর পর্যন্ত আয়তনের জলাশয় ব্যবহার করা যায়। নিষ্কাশনযোগ্য বা অযোগ্য মাটির পুকুর বা সিমেন্টের ট্যাংক হচ্ছে আঁতুড়ে মাছের বাচ্চা পালনের বিভিন্ন পদ্ধতি। নীচে আঁতুড়ে মাছের বাচ্চা পালনের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

স্টকিং-এর আগে জলাশয়ের প্রস্তুতিকরণ
একটা সিমেন্টের তৈরী আঁতুড় জলাশয়ের ছবি
জলজ লতাপাতা পরিষ্কার করা: মাছের পুকুরে প্রচুর লতাপাতা জন্মানো কাম্য নয়, যেহেতু সেগুলি পুষ্টি শোষণ করে পুকুরের উর্বরতা কমায়, শিকারী ও আগাছা মাছ/কীটপতঙ্গ বাড়তে দিয়ে মাছের মুক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, এবং জাল ফেলায় অসুবিধা করে। কাজেই জলজ আগাছা পরিষ্কার করা জলাশয় প্রস্তুতিকরণের প্রথম কাজ। সাধারনতঃ আঁতুড় ও চারাপালনের জলাশয়ে কেবল হাতে করেই এটা করা হয়, যেহেতু এগুলো অগভীর এবং ছোট হয়। বড় জলাশয়ে যান্ত্রিক, রাসায়নিক এবং জৈব পদ্ধতিতে জলজ আগাছা পরিষ্কার করা যেতে পারে।


শিকারী এবং আগাছা মাছ বিতাড়ন: 
শিকারী পশু, যেমন সাপ, কচ্ছপ, ব্যাঙ, পাখী, ভোঁদড় ছাড়াও পুকুরে উপস্থিত বিভিন্ন শিকারী/আগাছা মাছ বাচ্চা মাছেদের সাথে জায়গা ও অক্সিজেনের জন্য প্রতিযোগিতা করা ছাড়াও তাদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রেও সমস্যা সৃষ্টি করে।  শিকারী ও আগাছা মাছ নির্মূল করার জন্য পুকুরের জল বার করে দেওয়া ও জলাশয় শুকোনো অথবা উপযুক্ত মাছমারার ওষুধ প্রয়োগ করা হয় । চারা ছাড়ার তিন সপ্তাহ আগে হেক্টর-মি. প্রতি ২৫০০ কেজি মহুয়ার খইল দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। খইল অপ্রয়োজনীয় মাছ মারার ওষুধ হিসাবে কাজ করা ছাড়াও পচনের পরে জৈবখাদ্য হিসাবে কাজ করে, এবং স্বাভাবিক উর্বরতা বাড়ায়।  ৩৫০কেজি/হে-মি জল হিসাবে বাজার চলতি ব্লিচিং পাউডার (৩০% ক্লোরিন সম্বলিত) প্রয়োগও  অবাঞ্ছিত মাছ মারায় ভাল কাজ করে। ব্লিচিং পাউডার ব্যবহারের ১৮-২৪ ঘন্টা আগে ১০০ কেজি/হে-মি হিসাবে ইউরিয়া ব্যবহার করলে ব্লিচিং পাউডারের পরিমাণ অর্দ্ধেক  করা যায়।

জলাশয় উর্বর করা :
 পোনা মাছের বাচ্চা
প্ল্যাংকটন হচ্ছে মাছের পছন্দসই প্রাকৃতিক খাদ্য যা মাছ চাষের জলাশয়ে সার দিয়ে উৎপাদন করা হয়।মাটির পিএইচ এর উপর নির্ভর করে বাচ্চা তোলার জলাশয়ে শিকারী এবং আগাছা মাছ অপসারণের পর চুন  দেওয়া হয়। চুন দেওয়ার পর, জলাশয়ে জৈবসার, যেমন গোবর, পোল্ট্রীর পুরীষ বা অজৈব সার অথবা দুটোই একটার পর একটা দেওয়া হয়। হেক্টরে ৭৫০ কেজি চীনাবাদামের খইল, ২০০কেজি গোবর এবং ৫০ কেজি একক সুপার ফসফেট মিশ্রণ প্রয়োগ প্ল্যাংকটন উৎপাদনের জন্য উপযোগী হয়। উপরোক্ত পরিমাণের অর্দ্ধেক জল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে থকথকে পেস্ট তৈরি করে স্টকিং এর ২-৩ দিন আগে আঁতুড় জলাশয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাকিটা জলাশয়ে প্ল্যাংক্টনের মাত্রা বুঝে ২-৩টি কিস্তিতে প্রয়োগ করা হয়।  


জলজ কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ : জলজ কীটপতঙ্গ এবং তাদের শূককীটগুলি বেড়ে উঠতে থাকা চারা মাছের সাথে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করতে থাকে এবং আঁতুড়ে ডিম ফুটে বেরোনো ছানার ব্যাপক ধ্বংসের কারন হয়। সাবান ও তেলের সংমিশ্রণ (হেক্টর প্রতি ৫৬ কেজি হারে সস্তার উদ্ভিজ্জ তেল, তার ওজনের এক তৃতীয়াংশ যে কোনও সস্তার সাবানের সাথে মিশিয়ে) প্রয়োগ হাওয়ায় শ্বাসগ্রহণকারী জলজ কীটপতঙ্গ মারার সহজ ও কার্যকর পন্থা। এক হেক্টর জলে ১০০-২০০ লি কেরোসিন বা ৭৫ লি ডিজেল এবং ৫৬০ মিলি তরল সাবান বা ২-৩ কেজি ডিটারজেন্ট পাউডার মিশিয়ে সংমিশ্রণের পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার করা যায়।



স্টকিং
ডিম ফুটে বেরোনোর তিন দিন পরে ছানাগুলিকে আঁতুড় জলাশয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। সাধারণত ভোর বেলা স্টকিং করাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ছানাগুলিকে নতুন পরিবেশের সাথে মানানসই করিয়ে নিয়ে। মাটির আঁতুড় জলাশয়ের জন্য হেক্টরে ৩-৫মিলিয়ন বাচ্চা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়, যদিও সিমেন্টের জলাশয়ে ১০-২০ মিলিয়ন /হেক্টর রাখা যেতে পারে। আঁতুড়ে সাধারণতঃ শুধু পোনা মাছের প্রজাতির একক চাষেরই পরামর্শ দেওয়া হয়।



স্টকিং এর পরে জলাশয়ের পরিচালন
আগে যেমন আলোচনা করা হয়েছে সেই ভাবে মাছ চাষের ১৫ দিনব্যাপী সময়কাল ধরে ২-৩ দফায় ভাগ করে সার প্রয়োগ করা হয়। ভাল করে গুঁড়ো করা চিনাবাদামের খইল এবং চালের ভুষি ওজনের হিসাবে 1:1 অনুপাতে মিশিয়ে পরিপূরক খাদ্য হিসাবে প্রথম ৫ দিন ৬ কেজি/১০ লক্ষ ছানা হিসাবে এবং তারপরে প্রতি দিন ১২কেজি/১০ লক্ষ ছানা হিসাবে সমান দুটো কিস্তিতে ভাগ করে সরবরাহ করা হয়। বৈজ্ঞানিক পালন পদ্ধতি গ্রহণ করোর ফলে, চারাগুলি ১৫ দিনের পালন কালের মধ্যে ৪০-৬০% বেঁচে থাকার হারে ২০-২৫ মিমি আকারে পৌঁছায়। যেহেতু আঁতুড় জলাশয়ে চারা পালনকাল মাত্র ১৫ দিনে সীমিত, তাই একই আঁতুড় জলাশয় একাধিকবার ফসল তোলার জন্য ব্যবহার করা যায়, মাটির জলাশয় অন্ততপক্ষে ২-৩ টি ফসলের জন্য এবং সিমেন্টের জলাশয় ৪-৫টি ফসলের জন্য।


বাচ্চা-চারা পোনা পালনের জলাশয় পরিচালন
আঁতুড় জলাশয়ের থেকে বড় জলাশয় এবং অধিকতর বাঞ্ছনীয়ভাবে ০.২ হেক্টর পর্যন্ত আয়তনের জলাশয় বাচ্চা এবং চারা পালনের জন্য ব্যবহার করা হয়। তার জন্য বিভিন্ন ধাপগুলি নিম্নরূপ:

স্টকিং এর আগে জলাশয় প্রস্তুতি
স্টকিং এর আগে জলাশয় প্রস্তুতি পদ্ধতি, যথা জলজ লতাপাতা অপসারণ এবং শিকারী ও আগাছা মাছ ধ্বংস করা, আঁতুড় জলাশয় পরিচালন পর্বে আলোচিত পদ্ধতির সাথে একই রকম, যদিও চারাপালনের জলাশয়ের ক্ষেত্রে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। জলাশয়কে উর্বর করা হয় জৈব খাদ্য এবং অজৈব সার দিয়ে যার পরিমাণ নির্ভর করে কী ধরনের মাছ মারা বিষ ব্যবহার করা হয়েছে তার উপর। যদি মহুয়ার খইল মাছের বিষ হিসাবে ব্যবহার করা হয়, গোবরের প্রয়োগ 5 টন/হে তে নেবে যায়, কিন্তু সার হিসাবে মূল্যহীন কোন বিষ ব্যবহার করলে সাধারনতঃ 10 টন/হে হিসাবে গোবর সার প্রয়োগ করা হয়। এর এক তৃতীয়াংশ মূল ডোজ হিসাবে স্টকিং এর ১৫ দিন আগে প্রয়োগ করা হয়, এবং বাকিটা কিস্তিতে ১৫ দিন পর পর। অজৈব সারের উৎস হিসাবে ইউরিয়া এবং একক সুপার ফসফেট, যথাক্রমে ২০০কেজি ও ৩০০কেজি/হে/বছর হারে প্রতি ১৫ দিনে ভাগ ভাগ করে প্রয়োগ করার পরামর্শও দেওয়া হয়।


মাছের বাচ্চা স্টকিং করা
স্টকিং করার হার প্রধানত জলাশয়ের উৎপাদনশীলতা এবং কি ধরণের পরিচালন ব্যবস্থা অবলম্বিত হবে তার উপর নির্ভর করে। স্বাভাবিক অবস্থায় পালনের জলাশয়ে ০১-০৩ মিলিয়ন/হে ঘনত্বে স্টকিং এর পরামর্শ দেওয়া হয়। আঁতুড় পর্ব একই জাতের মাছের চাষ সীমাবদ্ধ থাকলেও, পালনের সময়ে গ্রো-আউট উৎপাদনের মতই বহুচাষিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন জাতের পোনামাছ রাখা হয়৷


স্টকিংয়ের পরে জলাশয়ের পরিচলন:
চারা মাছ পালনের জন্য ৫-১০% হারে খাওয়ানো হয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পরিপূরক খাবার ওজন হিসাবে 1:1 অনুপাতে চীনাবাদামের খইল এবং চালের ভুষিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও মিশ্র খাদ্য তৈরি করার জন্য অপ্রচলিত উপাদানও খাবারের সাথে মেলানো যায়। গ্রাস কার্প ছাড়া হলে উলফিয়া, লেম্না এবং স্পিরোডেলা জাতীয় ডাকউইড দেওয়া হয়। জলের গভীরতা 1.5 মি রাখার এবং মাঝে মাঝে সার দেওয়ার মত অন্যান্য পরিচালন ব্যবস্থার পরামর্শ দেওয়া হয়৷ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পালন ব্যবস্থা অবলম্বন করলে পালন জলাশয়ে চারা মাছগুলির 70-90% জীবিত থাকে এবং সেগুলি 80-100 মিমি/8-10গ্রা আকারের হয়।


চারাপালনের বাণিজ্যিক দিক
ক্রঃসংখ্যা
বিষয়
অংক(টাকায়)
I.
খরচ

A.
পরিবর্তনশীল মূল্য

1.
জলাশয় ভাড়ার মূল্য
5,000
2.
ব্লিচিং পাউডার (10 পি পি এম ক্লোরাইড)/অন্য বিষ
2,500
3.
খাদ্য ও সার
8,000
4.
মাছের ছানা (5মিলিয়ন @  5,000 টাকা/মিলিয়ন)
25,000
5.
পরিপূরক খাদ্য (750 কেজি@ 10/কজি)
7,500
6.
পরিচালন এবং ফসল তোলার জন্য শ্রমিক(100 মানব-দিবস@50টাকা/মানব-দিবস)
5,000
7.
বিবিধ খরচ
5,000

উপ-মোট
58,000
B.
সর্বমোট মূল্য

1.
পরিবর্তনশীল মূল্য
58,000
2.
পরিবর্তনশীল মূল্যের উপর সুদ  (বছরে 15% হিসাবে একমাসের জন্য )
0.725

সর্বমোট যোগফল
58,725
» 59.000
II.
সর্বমোট আয়


৭হাজার টাকায় এক লাখ হিসাবে ১৫ লাখ মাছের বাচ্চা বিক্রয় থেকে
1,05,000
III.
খরচ বাদ দিয়ে রোজগার  (সর্বমোট আয় – সর্বমোট মূল্য)
46,000
একটা বর্ষা ঋতুতে(জুন – আগষ্ট) দুটো ফসল করা যায়। এভাবে দুটো ফসল থেকে এক হেক্টর জলাশয়ের ক্ষেত্রে মোট রোজগার হবে  92,000 টাকা।
চারা পোনা পালনের বাণিজ্যিক দিক
ক্রঃ সংখ্যা
বিষয়
অংক (টাকায়)
I.
খরচ

 

A.
পরিবর্তনশীল মূল্য

 

1.
জলাশয় ভাড়ার মূল্য  
10,000
2.
ব্লিচিং পাউডার (10 পি পি এম ক্লোরাইড)/অন্য বিষ
2,500
3.
খাদ্য ও সার
3,500
4.
মাছের বাচ্চা (৭০০০টাকায় একলক্ষ বাচ্চা হিসাবে তিনলক্ষ বাচ্চা
21,000
5.
পরিপূরক খাদ্য (5 টন @ 7,000 টাকা/টন)
35,000
6.
মজুরী (পরিচালন এবং ফসল তোলার জন্য100মানব-দিবস @ 50টাকা/মানব-দিবস)
5,000
7.
বিবিধ খরচ
3,000

উপ-মোট 
80,000



B.
সর্বমোট ল্য

1.
পরিবর্তণশীল মূল্য
80,000
2.
আবর্তক খরচের উপর বছরে ১৫%হিসাবে তিনমাসের সুদ
3,000

সর্বমোট যোগফল
83,000



II.
সর্বমোট আয়


  500টাকা /1000 চারা পোনা  হিসাবে 2.1 লক্ষ   চারা পোনা বিক্রয় থেকে
1,05,000



III.
নিট আয় (সর্বমোট আয় -  সর্বমোট ল্য)
22,000


SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment