বোয়াল মাছের কৃত্রিম প্রজনন

ব্যক্তিপর্যায়ে হ্যাচারি শিল্পে উদ্ভাবনী সাফল্য বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির মাছ বোয়াল। প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে এই মাছটিকে আগের মত আর পাওয়া যায় না। অথচ সামান্য একটু উদ্যোগ নিলেই এই বোয়াল মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যায় অনায়াসে। বোয়াল একটি রাক্ষুসে স্বভাবের মাছ। কাজেই এ মাছটিকে প্রজননের আওতায় এনে উৎপাদন করতে কয়েকটি বিশেষ দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বোয়াল মাছ প্রজননের ইতিকথাঃ ১৯৯৮ সালে বন্যার সময় প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে প্রায় ২০০টি আঙ্গুলের মত ছোট বোয়াল মাছের পোনা সংগ্রহ করেছিলাম কৃত্রিম প্রজননের গবেষণার জন্যে। পরবর্তীতে এই মাছগুলোকে কার্প জাতীয় ব্রুডমাছের সাথে লালন-পালন করি। লালন-পালন করতে গিয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয় যে, বোয়াল মাছ ছোট থাকার কারণে এবং কার্প জাতীয় মাছ বড় থাকার কারণে বোয়াল মাছ কোন মাছকেই ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারেনি। এভাবে দুবছর পর বোয়াল মাছের পেটে ডিম আসে। এরপর ২ জোড়া পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে প্রজননের জন্য নির্বাচন করি। প্রথমে সেখান থেকে ২টি স্ত্রী মাছকে ২টি ভিন্ন মাত্রায় ডোজ দেই। ২টি মাত্রাতেই বোয়াল মাছ ডিম দেয় এবং পেটে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ডিম বের করি। ২টি মাছের ডিমকে আলাদাভাবে ২টি ট্রেতে বিছিয়ে দিই এবং একই সাথে কিছু ডিমকে বোতল জারে রেখে দেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বোয়াল মাছের ডিম খুবই আঁঠালো। যে কারণে বোতল জারে ডিম দিলে তা জারের গায়ে আটকে থাকে। লবণ-জলে ধুলে আঁঠালো ভাব দূর হয় এবং জারে দেওয়া যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটার হার নেই বললেই চলে। এ কারণে এ পদ্ধতি বাতিল করে পরবর্তীতে ট্রেতেই ডিম ফুটাই। আগেই বলেছি বোয়াল মাছের ডিমগুলোকে ২টি টে্্রতে বিছিয়ে দিয়ে ২/৩ ইঞ্চি পানির উচ্চতাসম্পন্ন পাইপ ছিদ্র করে তা দিয়ে কৃত্রিম ঝর্ণার ব্যবস্থা করি। ২টি ট্রের মধ্যে একটিতে বাচ্চা ফুটে ভাল অবস্থায় থাকে আর অন্যটিতে বাচ্চা ফুটে মারা যায়। যে ডোজে ভাল বাচ্চা পাওয়া গেছে সেটাকে আদর্শ মাত্রা হিসেবে ধরে পরবর্তীতে সে ডোজই নির্ধারণ করি। এভাবে ২ বছরে আরও গবেষণা করি বোয়াল মাছের কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে। পেটে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ডিম বের করে তারপর চেষ্টা করি হরমোন প্রয়োগের পর প্রাকৃতিকভাবে ডিম সংগ্রহ করা যায় কি না। এবারও আমি সফলতা লাভ করি। অর্থাৎ হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে সার্কুলার ট্যাংকে ছাড়ার পর প্রাকৃতিকভাবে নিজেরাই প্রজনন করে। এভাবে নিবিড় গবেষণা করে ২০০৩ সালে কারও কোন সহযোগিতা ছাড়াই আমাদের দেশে আমরা ব্রহ্মপুত্র ফিস সীড কমপ্লেক্স (হ্যাচারি)থেকে প্রথম বোয়াল মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা লাভ করি। বোয়ালের প্রজনন মৌসুমঃ মধ্য এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাস পর্য- বোয়াল মাছ ডিম দিয়ে থাকে। প্রজননের সময় খুব সহজেই পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে শনাক্ত করা যায়। প্রজননের জন্য উপযোগী স্ত্রী ও পুরুষ মাছ বাছাইঃ আগেই উল্লেখ করেছি, প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট ভর্তি ডিম থাকে আর পুরুষ মাছের পেট সাধারণ মাছের মত থাকে। তাছাড়া পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিলে সাদা মিল্ট বেরিয়ে আসে। এ থেকে সহজেই বোয়ালের পুরুষ ও স্ত্রী মাছ শনাক্ত করা যায়। হরমোন ইঞ্জেকশনের দ্রবণ তৈরি এবং ইঞ্জেকশন দেওয়ার পদ্ধতিঃ বোয়াল মাছকে পিজি• (পিটইটারী গ্ল্যান্ট) হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশন করলেই ডিম দিয়ে থাকে। প্রথম ডোজের সময় শুধুমাত্র স্ত্রী মাছকে ইঞ্জেকশন দিতে হয়। ডোজের মাত্রা ২ মিঃ গ্রাঃ কেজি। ৬ ঘন্টা পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয় ৪ মিঃ গ্রাঃ/ কেজি। ২টি পদ্ধতিতে বোয়ালের ডিম সংগ্রহ করা যায়। প্রথম পদ্ধতি (চাপ প্রয়োগ পদ্ধতি)ঃ মাছকে পিজি হরমোন ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে আলাদা আলাদা হাউজে রাখতে হবে। দ্বিতীয় ডোজের ৬ ঘন্টা পর সাধারণত বোয়াল মাছ ডিম দিয়ে থাকে। মাছের ডিম পাড়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যখনই ২/১টি ডিম বের হতে দেখা যাবে তখনই মাছগুলোকে একে একে হাউজ থেকে তুলে আনতে হবে। এবার স্ত্রী মাছের পেটে আে- করে চাপ দিলেই ডিম বের হতে থাকবে। স্ত্রী মাছের ডিম বের করার পর তাৎক্ষণিকভাবে পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিয়ে মিল্ট বের করে ডিমের উপর পাখির পালক দিয়ে ভালভাবে মিশাতে হবে। এরপর ডিমগুলোকে ২/৩ বার বিশুদ্ধ পানিতে পরিষ্কার করে ৩/৪ ইঞ্চি উচ্চতার পানির হাউজে রাখতে হবে। চিকন প্লাষ্টিক পাইপকে ছিদ্র করে ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে ২০/২২ ঘন্টার মধ্যেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হবে। দ্বিতীয় পদ্ধতি (প্রাকৃতিক পদ্ধতি)ঃ প্রথম পদ্ধতিতেই মাছকে হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে একসাথে একটি বড় হাউজে ছেড়ে দিতে হবে। তাতে দ্বিতীয় ডোজের ৬ ঘণ্টার মধ্যেই প্রাকৃতিকভাবে এরা ডিম পারবে। ডিম পারা শেষ হলে ব্রুডমাছগুলোকে সর্তকতার সাথে সরিয়ে নিতে হবে। তারপর হাউজের পানি কমিয়ে ৩/৪ ইঞ্চি রেখে ছিদ্রযুক্ত পাইপ দিয়ে পানির ঝর্ণা দিতে হবে। এখানেও ২০/২২ ঘন্টার মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা বের হবে। পোনা লালন-পালন পদ্ধতিঃ বোয়ালের পোনা খুবই রাক্ষুসে স্বভাবের। ডিম থেকে ফুটার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই একটি আরেকটিকে খেতে শুরু করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, অন্যান্য মাছের রেনু পোনা ডিমের কুসুম বা ক্ষুদ্র আকৃতির প্ল্যাংকটন খেলেও বোয়ালের পোনা ডিমের কুসুম বা কোন ধরনের প্ল্যাংকটন খায় না। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে জীবিত অবস্থায় মাছের রেনু বা পোনাকে খেতে দিতে হয়। এভাবে ৮/১০ দিনেই ২ ইঞ্চি সাইজের পোনায় পরিণত হয়। বোয়াল মাছের চাষ পদ্ধতিঃ গবেষণায় দেখা গেছে যে, বোয়াল মাছ এককভাবে চাষ করা যায় না। একটা আরেকটাকে খেতে খেতে শেষ পর্য- আর বাকি থাকে না। তা ছাড়া কৃত্রিম খাবার না খাওয়ায় মাছগুলো খুব একটা বড়ও হয় না। তাই এদেরকে বিভিন্ন মাছের সাথে মিশ্র চাষ করে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। মজুদ ঘনত্ব মিশ্রচাষে প্রতি ৫ শতাংশে ১টি মাছ। মাছ ছাড়ার সময় একটা দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে যে, বোয়ালের পোনা যেন কোন অবস্থাতেই পুকুরের অন্যান্য মাছের আকারের সমান না হয়। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য মাছের ওজন যখন ১৫০/২০০ গ্রাম ওজন হবে সেখানে ২ ইঞ্চি সাইজের বোয়ালের পোনা ছাড়তে হবে। আর তা না হলে বোয়াল দ্রুত বড় হয়ে অন্যান্য মাছ খেয়ে ফেলতে পারে। বিলুপ্ত প্রায় এই বোয়াল মাছের চাষ নিয়ে আমাদের গবেষণা এখনও চলছে। আশার কথা ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই বোয়াল নিয়ে এ বছর কাজ শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমার সাথে যোগাযোগও করা হয়েছে। যদিও অনেক আগেই আমি বোয়াল মাছের পোনা উৎপাদন করেছি এবং চাষ কৌশল এগিয়ে নিয়ে গেছি। তবু তাদের এই চেষ্টা যদি এর চাইতে আরও লাগসই প্রযুক্তি হয় তাহলে জাতি নিঃসন্দেহে উপকৃত হবে। - একেএমনূরুল হক ব্রহ্মপুত্র সিড ফিস এণ্ড হ্যাচারি কমপ্লেক্স শম্ভুগঞ্জ
SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment