থাই পদ্ধতিতে গলদা চিংড়ি নার্সিং (জুভেনাইল/পীচ তৈরি)


বর্তমানে আমাদের দেশে হিমায়িত চিংড়ি একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য। প্রতি বছর এ খাত থেকে কম বেশি ২৫০০ কোটি টাকা আয় হয়। দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনায় এটি "সাদা সোনা" হিসাবে পরিচিত। দিনের পর দিন এর চাষ বেড়েই চলেছে। কিন্তু চাষের এলাকা বাড়লেও এর উৎপাদন হার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এর অনেকগুলো কারণ থাকলেও অন্যতম কারণ হিসাবে বলা যায় নার্সিং না করে সরাসরি পি,এল ঘেরে অবমুক্তকরণ। এর ফলে পি,এল-এর মৃত্যুহার অনেক বেড়ে যায়, রোগ বালাই বেশি হয় এবং বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হয়। অবশ্য ইদানিং অনেক চিংড়ি চাষীই সরাসরি পি, এল না ছেড়ে বিভিন্ন উৎস থেকে দেড়-দুই মাস বয়সী গলদার জুভেনাইল/পীচ সংগ্রহ করে ছেড়ে থাকেন। নার্সিংকৃত দেড়-দুই মাস বয়সী জুভেনাইল/পীচ দ্রুত বৃদ্ধিপায় এবং এদের মৃত্যুহার অনেক কম হয় ফলে চাষীরা বেশি লাভবান হয়। চাষীদের মধ্যে গলদার পীচ ছাড়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়লেও এর প্রাপ্যতা সহজলভ্য না হওয়ায় কিংবা নার্সিং-এর পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে পি, এল ছেড়ে থাকেন। অনেকে আবার নদী থেকে উচ্চ দামে পীচ সংগ্রহ করে থাকেন। কাজেই এই পরিস্থিতিতে আপনি যদি থাই পদ্ধতিতে দেড়-দুই মাস বয়সী গলদা চিংড়ি নার্সিং করে সেই পোনা ঘেরে অবমুক্ত করেন অথবা নার্সিংকৃত পোনা বাহিরে বিক্রি করেন, তাহলে আশা করা যায় সেখান থেকে আপনি ভাল মুনাফা পেতে পারেন।   সুবিধাসমূহ  ১।  মাত্র দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যেই এই চাষ সম্ভব।  ২।  অল্প জায়গাতে বিশেষ করে ১০-১৫ শতকের মধ্যেই চাষ করা যায়।  ৩।  তুলনামূলকভাবে অনেক কম পুঁজি লাগে।  ৪।  নার্সিংকৃত পীচ (জুভেনাইল) চাষীদের কাছে অত্যন্ত চাহিদা সম্পন্ন।  ৫।  ভাল দাম পাওয়া যায়।  ৬।  বৎসরে একাধিকবার চাষ করা সম্ভব।  ৭।  মৌসুমী পুকুর কিম্বা রাস্তার পাশের মৌসুমী জলাশয়ে চাষ করা যায়।  ৮।  ঘেরে নার্সিংকৃত পীচ খুব দ্রুত বড় হয় এবং মৃতু্যহার অনেক কম হয়।   চাষ পদ্ধতি  থাইল্যান্ডে গলদার চাষ সম্পূর্ণরূপে হ্যাচারীতে উৎপাদিত পোষ্টলার্ভার উপর নির্ভরশীল। নার্সারী চাষীরা তাদের নিকটবর্তী খামার থেকে পি, এল ক্রয় করে দেড়-দুই মাস নার্সিং করে পরে তাদের নির্ধারিত ঘেরে অবমুক্ত করে থাকে। এক্ষেত্রে চাষ পদ্ধতি অনেকটা নিম্নরূপ   পুকুর প্রস্তুতি  পনের থেকে ত্রিশ শতকের ছোট পুকুরই নার্সিং-এর জন্য উপযুক্ত। পুকুরটি রৌদ্র আলোকিত খোলামেলা জায়গায় হলে ভাল হয়। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন পুকুরটিকে সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে ফেলা হয়। পুকুরের মাটি রৌদ্রে ফেটে গেলে ট্রাক্টর দিয়ে আড়াআড়িভাবে ২-৩টি চাষ দেয়া হয় এবং পুকুরে যাতে কোনো গ্যাস সৃষ্টি না হয় সেজন্য পুকুরের তলদেশে কিছু বালি ছিটিয়ে দিয়ে মই অথবা অন্য কোনোভাবে পুকুরের তলা সমান করে দেয়া হয়।   চুন ও সার প্রয়োগ  এরপর চাষকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন আগেরদিন গুলিয়ে পরের দিন পাড়সহ সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দেয়া হয়। চুন প্রয়োগের তিন দিন পর প্রতি শতকে পাঁচ কেজি পচা গোবর অথবা চার কেজি মুরগির বিষ্ঠা ছিটিয়ে ২-২.৫০ ফুট পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। অধিকাংশ গলদা খামারে পি, এল প্রতিপালনের সময় কিছু লবণাক্ত পানি যোগ করে পানির লবণাক্ততা ২-৩ পি.পি.টি করা হয়। কারণ নার্সারী থেকে যখন পি. এল ক্রয় করা হয়, তখন সেখানকার পানির লবণাক্ততা থাকে ১২ পি.পি.টির অধিক। এই অবস্থায় পি, এল সরাসরি স্বাদু পানিতে মজুদ করলে যে ধকল হবে তা থেকে আংশিক রেহাই পাওয়ার জন্য গলদার নার্সারী পুকুরের পানির লবণাক্ততা সামান্য বাড়ানো হয়। পুকুরে পানি সরবরাহ করার পর প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২৫০ গ্রাম টিএসপি সার সপ্তাহে একবার প্রয়োগ করা হয়। পোনা মজুদের তিন সপ্তাহ পর আর কোন সার প্রয়োগ করা হয় না।   আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা  মজুদকৃত পি,এল প্রথম দিকে খুব দ্রুত খোলস পরির্বতন করে। এই সময় এরা থাকে খুব দুর্বল এবং নাজুক। এজন্য মজুদকৃত পি, এল আশ্রয়স্থল খোঁজে। সে কারণে পি,এল-এর আশ্রয়ের জন্য প্রতি শতকে একটি অথবা দুটি করে আধা শুকনো নারকেল পাতা, খেজুর পাতা অথবা তাল পাতা প্রদান করা যেতে পারে। খেজুর পাতা হলে সে ক্ষেত্রে পাতার অগ্রভাগের সূঁচালো অংশ কেটে দিতে হবে।   পি,এল মজুদ  পুকুরে পানি ও সার দেয়ার ৫-৬ দিন পর প্রতি শতকে ৪০০ পি,এল মজুদ করা যেতে পারে। পি,এল মজুদ করার সময় তাকে ধীরে ধীরে ঘেরের পানির সাথে খাপ খাইয়ে মজুদ করা উচিত নতুবা মৃতু্যহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে সকল চাষী মূল পুকুর কিংবা ঘেরেই পি,এল নার্সিং করতে চান তাঁরা পুকুর/ঘেরের একচতুর্থাংশ জায়গা পলিপ্রোপাইলিন বা পলিথিন শীট দিয়ে ঘিরে একটা নার্সারী পেন তৈরি করতে পারেন।   পি,এল-এর খাদ্য (ডিমের কাস্টার্ড)  পি,এল-এর খাদ্য হিসাবে ডিমের কাস্টার্ড প্রয়োগ করা হয়। প্রতি ৬টি ডিমের সাথে তিন টেবিল চামচ গুড়া দুধ ভালভাবে ফেঁটে বাষ্পযোগে সিদ্ধ করে ডিমের কাস্টার্ড তৈরি করা হয়। তারপর তারের চালুনী দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে সেগুলো পুকুরে প্রয়োগ করা হয়। পি,এল মজুদ করার পর প্রথম সাতদিন শুধুমাত্র ডিমের কাস্টার্ড খেতে দেয়া হয়। অষ্টম দিন থেকে ১৫তম দিন পর্যন্ত ডিমের কাস্টার্ডের সাথে পিলেট খাদ্য প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ডিমের কাস্টার্ড প্রদান কমিয়ে পিলেট খাদ্য সরবরাহ বাড়ানো হয় এবং ১৫তম দিনের পর ডিমের কাস্টার্ড প্রদান না করে ১৬তম দিন থেকে শুধুমাত্র পিলেট খাদ্য দেয়া হয়। গলদা চিংড়ির নার্সিং-এর ক্ষেত্রে ডিমের কাস্টার্ড একটি পুষ্টিকর ও গুণগতমানসম্পন্ন খাবার যা সাধারণত আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয় না অথবা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এই প্রযুক্তি আমরা অনুসরণ করতে পারছি না। কাজেই গলদা চিংড়ির নার্সিং-এর ক্ষেত্রে উত্তম ফল লাভ করার জন্য ডিমের কাস্টার্ড প্রদান পদ্ধতি চালু করা খুবই জরুরি।   পি,এল-এর খাদ্য (পিলেট খাবার)  নার্সিং-এর ক্ষেত্রে ১৫তম দিনের পর শুধুমাত্র পিলেট খাবার প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার থেকে পি,এল-এর জন্য নির্ধারিত পিলেট খাদ্য (স্টারটার) ক্রয় করে প্রয়োগ করা যেতে পারে অথবা নিম্নের সূত্রটি ব্যবহার করে বাড়ীতেই পিলেট খাদ্য তৈরি করা যেতে পারে।  ১।  ফিশ মিল ২৫%  ২।  চিংড়ির গুড়ো/বোন এন্ড মিট মিল ১০%  ৩।  ব্লাড মিল ৫%  ৪।  সরিষার খৈল ২০%  ৫। কুঁড়া ১৫%  ৬।  ভূষি ১০%  ৭।  ময়দা ৫%  ৮।  চিটাগুড় ৫%  ৯।  ঝিনুকের গুড়া ২%  ১০।  লবণ ১%   উপরের সূত্র মোতাবেক খাদ্য তৈরি সম্ভব না হলে কমপক্ষে উন্নত তৈরি খাবার হিসাবে ফিশমিল ৩০%, খৈল ২৫%, কুঁড়া ২২%, ভূষি ২০%, ঝিনুকের গুড়া ২% এবং লবণ ১% মিশিয়ে পিলেট তৈরি করে খাওয়ানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে খৈল ২.৫ গুণ পানির সাথে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং অন্য উপাদানগুলো উত্তমরূপে মিশ্রিত করার পর সেগুলো খৈলের মধ্যে দিয়ে মন্ড তৈরি করতে হবে। অতঃপর হাতে চালিত অথবা শক্তি চালিত হ্যান্ড গ্রাইন্ডার মেশিন দিয়ে পিলেট তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন নম্বরের ডাইস ব্যবহার করে চিংড়ির সাইজের সঙ্গে সংগতি রেখে চিকন বা মোটা পিলেট বের করা যায়। এর পর সেগুলো শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এটিও সম্ভব না হলে খৈল ব্যতীত অন্য উপাদানগুলো দিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। অতঃপর প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্য লাগবে তার চার ভাগের এক ভাগ খৈল পানিতে ভিজিয়ে (৬-১২ ঘন্টা) বাকী তিনভাগ মিশ্রণের মধ্যে মিশিয়ে শুকনো দানা করেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি খাদ্য ব্যবহারের উত্তম পন্থা নয় এবং এখানে অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।   খাদ্য প্রয়োগের মাত্রাঃ  প্রতিদিন নূন্যতম তিন বেলা খাদ্য প্রদান করা উচিত। সূর্যোদয়, (সকাল ১০-১১ ঘটিকা) এবং সূর্যাস্তের সময়। চিংড়ি সেহেতু নিশাচর সেজন্য সন্ধ্যাবেলায় দিনের মোট খাদ্যের ৫০%, ভোরে ৩০% এবং দুপুর বেলা ২০% দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্য তৈরি করলে ভাল হয়। অবশ্য যাদের বাড়িতে রেফ্রিজারেটর আছে তারা কয়েক দিনের খাবার একসঙ্গে তৈরি করতে পারেন। প্রতি ১০০০ পি,এল-এর জন্য প্রতিদিন নিম্ন মাত্রায় খাবার প্রদান করা যেতে পারে-   অন্যান্য পরিচর্যাঃ  নার্সিং-এর ক্ষেত্রে পি,এল-এর আশ্রয়স্থল হিসাবে ছিদ্রযুক্ত মাটির ভাঙ্গা পাইপ অথবা কুমোরের নিকট থেকে ছিদ্রযুক্ত ৩/৪ ফুট দৈর্ঘ্যের মাটির পাইপ তৈরি করে নিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি শতকের জন্য ২-৩টি আশ্রয়স্থল দেয়া যেতে পারে। পানিতে যাতে অক্সিজেনের সমস্যা না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যে সকল চাষী মূল পুকুরেই পি, এল নার্সিং করেন তাঁরা দেড়-দুই মাস পর পলিপ্রপাইলিনের পেন তুলে ফেলে দেন তখন সমগ্র পুকুরে পি,এল ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পেন উঠিয়ে ফেলার পূর্বে এর মধ্যে কী পরিমাণ পি,এল বেঁচে আছে এবং তাদের গড় ওজন কত তা স্যাম্পলিং করে দেখা হয়।   নার্সিংকৃত পি,এল আহরণ  দুই মাস বা কোনো কোন ক্ষেত্রে দেড়মাস পর নার্সিংকৃত পি,এল জুভেনাইল/পীচে রূপান্তরিত হয়। তখন পানি শুকিয়ে অথবা অন্য কোনো ভাবে এদের ধরে মজুদ ঘেরে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০টি করে ছাড়া হয় কিংবা অন্য চাষীদের নিকট উচ্চদামে বিক্রি করা হয়। প্রতি পীচ (৫/= টাকা, কোন ক্ষেত্রে ৭-৮/= টাকা পর্যন্ত)।   শেষ কথা  আমাদের দেশে গলদা চিংড়ির নার্সিং পদ্ধতি সামপ্রতিক কালের একটি ব্যবস্থাপনা। এতদিন পর্যন্ত সবধরনের ঘের/পুকুরে পোষ্টলার্ভা মজুদ করে প্রতিপালন করা হতো এবং সেগুলো বাজার উপযোগী করতে প্রায় ৮-৯ মাস সময় লাগতো এবং মৃত্যুহার অনেক বেশি হতো। অন্যদিকে নার্সিংকৃত পি,এল ছেড়ে পরিচর্যা করে ৫-৬ মাসের মধ্যেই গলদার ফলন পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুহার খুবই কম। কাজেই যত তাড়াতাড়ি আমরা ঘের কিংবা পুকুরে নার্সিংকৃত পি,এল ছাড়বো তত তাড়াতাড়ি আমরা কাঙ্খিত ফলন পেতে সক্ষম হবো।  * খুলনা, সাতক্ষিরা এবং বাগেরহাট অঞ্চলে দেড় থেকে দুই মাস বয়সী নার্সিংকৃত কিংবা নদী থেকে প্রাপ্ত গলদার জুভেনাইলকে স্থানীয়ভাবে পীচ বলে।  লেখক: কৃষিবিদ এ.কে.এম রোকসানুল ইসলাম এবং কৃষিবিদ ফরিদা ইয়াসমিন যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সোনাডাঙ্গা, খুলনা।
SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment