থাইল্যান্ড থেকে এ পাঙ্গাস মাছ বাংলাদেশে আনা হয় ১৯৯০ সনে। এ দেশে সফল প্রজনন করানো হয় ১৯৯৩ সনে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীগুলোর মধ্যে এ মাছের বাস পরিলক্ষিত হয়। একটি থাই পাঙ্গাসের ওজন প্রায় ১০-১৫ কেজি হতে পারে এবং এ মাছ ডিম উৎপাদন করতে পারে তার প্রতি গ্রাম দেহ ওজনের ১০০-১৩০টি। থাই পাঙ্গাস ২-৩ বছর বয়সে ডিম দেয়। প্রতিদিন মাছের দেহের ওজনের ৫-৬% সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয়, সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ফিশমিল ২০%, পচা খৈল ২৫%, ভুসি/কুঁড়া ৫০%, আটা ৪% এবং চিটাগুড় ১%-এর মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ফিশমিল ৪০%, গমের ভুসি ৩০% এবং সরিষার পচা খৈল ৩০%-এর মিশ্রণ ব্যবহার করলেও সুফল পাওয়া যায়। প্রজনন পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে পিজি ও এইচ সিজি দ্বারা প্রজনন করানো যায়। স্ত্রী মাছের জন্য এর ব্যবহার মাত্রা প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ৬-৮ মিলিগ্রাম ইনজেকশন সমান দুভাগে ভাগ করে দুবারে ইনজেকশন করতে হয়। মাছে দ্বিতীয় ইনজেকশনের প্রায় ৪-৬ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। ইনজেকশন দিয়ে মাছগুলোকে পাকা চৌবাচ্চার ২-৩ ফুট গভীর পানিতে রাখতে হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশনের পর বেশি দেরি করলে স্ত্রী মাছ চৌবাচ্চায় ডিম ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া চাপ পদ্ধতিতে মাছের ডিম ও শুক্রাণু বের করে ট্রেতে নিষেক করানো যায়। ডিম পরিচর্যা প্রথম ইনজেকশন দেয়ার ৬ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় ইনজেকশনে অবশিষ্ট পিজি/এইচসিজি প্রয়োগ করতে হবে। স্ত্রী মাছের দ্বিতীয় ইনজেকশনের সময় পুরুষ মাছকে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ২ মিলিগ্রাম পিজির একটি মাত্র ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হয়। দ্বিতীয় ইনজেকশন দেয়ার ৪-৬ ঘণ্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। তবে পরিপক্ব মাছ সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে একটি মাত্র ইনজেকশনের পরও ডিম দিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ইনজেকশনের ১০-১২ ঘণ্টা পর চাপ প্রয়োগে ডিম ও শুক্রাণু সংগ্রহ করতে হবে। তবে পুরুষ মাছকে স্ত্রী মাছের ৬ ঘণ্টা পর ইনজেকশন দিতে হবে। চাপ পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহ ও নিষিক্তকরণ প্রধানত চাপ প্রয়োগ করে পাঙ্গাস মাছের ডিম ও শুক্রাণু সংগ্রহ করা হয়। স্ত্রী মাছকে দ্বিতীয় ইনজেকশন দেয়ার ৩-৪ ঘণ্টা পর প্রতি ঘণ্টায় পরীক্ষা করতে হবে। এ সময় স্ত্রী মাছের তলপেটে সামান্য চাপ প্রয়োগ করলে যদি ডিম বের হয়ে আসে তাহলে বুঝতে হবে ডিম দেয়ার সময় হয়েছে। তখন চৌবাচ্চা হতে স্ত্রী মাছ তুলে পরিষ্কার, শুকনো এনামেল/প্লাস্টিকের গামলার ওপর ধরে মাচের তলপেটে ওপর হতে নিচের দিকে হাত দিয়ে আস্তে চাপ প্রয়োগ করলে ডিম বের হয়ে আসবে। একইভাবে পুরুষ মাছ হতে শুক্রাণু সংগ্রহ করে ডিমের ওপর ছড়িয়ে দিতে হয়। ডিমে পুরুষ মাছের শুক্রাণু মেশানোর পর মুরগি/পাখির পালক দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে ৩০ সেকেন্ড হতে ১ মিনিট পর্যন্ত মিশিয়ে ডিম নিষিক্ত করতে হবে। হ্যাচিং ট্রেতে নিষিক্ত ডিমের পরিচর্যা ও পরিস্ফুটন পাঙ্গাস মাচের ডিম আঠালো বিধায় লম্বা আকৃতির ট্রে/অগভীর চৌবাচ্চায় ডিম থেকে বাচ্চা পরিস্ফুটন করা হয়। এজন্য গ্যালভানাইজ জিআই দিয়ে ২০০x৬০x২০ সেন্টিমিটার আয়তনের হ্যাচিং ট্রে তৈরি করা যেতে পারে। ট্রের মধ্যে লোহার রড বা বাঁশের চটি দিয়ে একটি ফ্রেম তৈরি করে ফ্রেমের ওপর জর্জেট কাপড় বা সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত হাপার কাপড় স্থাপিত করে একটি অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। অবকাঠামোর মাঝে ৮-১০ সেন্টিমিটার লম্বালম্বি কিছু জায়গা ফাঁকা রাখা যেতে পারে। নিষিক্ত ডিম অবকাঠামোর ওপর ছড়িয়ে দেয়ার পর ট্রেতে পানির প্রবাহ দিয়ে পানি দিতে হবে। কাপড়ের কাঠামোর ওপর ডিমগুলো যাতে সবসময় পানির সামান্য নিচে থাকে এ বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। পানির ২৭-২৯ সে. তাপমাত্রায় ২০-২৬ ঘণ্টার মধ্যেই পাঙ্গাসের ডিম থেকে রেণু ফুটে বের হয়। ডিমের আঠালো ভাব দূর করে হ্যাচিং ফানেলে ডিম পরিস্ফুটন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিমের আঠালোভাব দূর করার জন্য এঁটেল মাটি, গুঁড়া দুধ অথবা ইউরিয়া কার্বমাইল দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে। নিষিক্ত ডিম উপরোক্ত দ্রবণের সাহায্যে ৩-৪ বার ধুয়ে হ্যাচিং ফানেলে দিতে হবে। হ্যাচিং ফানেলের পানি নিচ থেকে উপরের দিকে প্রবাহিত হতে হবে এবং একই পথে পানিতে বাতাস সরবরাহ করতে হবে। হ্যাচিং ফানেল কাপড় দ্বারা তৈরি করা হলে ফানেলের ওপর বর্ডার একটি চৌবাচ্চা অথবা স্পুলিং পুলে ঝুলিয়ে দেয়া হয় এবং নিচের মুখ পানির পাইপ এবং বাতাসের পাইপের সাথে বেঁধে দিতে হয়। হ্যাচিং ট্রেতে রেণু পোনার পরিচর্যা : রেণু পোনা যত্ন সহকারে পরিচর্যা করা আবশ্যক। থাই পাঙ্গাসের রেণুর মাঝে আত্মভূক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেণু একে অপরকে খেয়ে ফেলে। সে কারণে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত খাবার না দিলে রেণুর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। হ্যাচিংয়ের ১৮ ঘণ্টা পর থেকে খাবার দেয়া শুরু করতে হবে। যদিও রেণু পোনার কুসুম থলি ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে তবুও আত্মভুক বৈশিষ্ট্যের কারণে কুসুম থলি মেলে যাওয়ার আগেই ওদের মধ্যে খাদ্য গ্রহণের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় এবং খাদ্যের জন্য এরা প্রতিযোগিতা শুরু করে। এ সময়ে খুব হালকা আমিষসম্পন্ন খাদ্য, যেমন- সিদ্ধ মাছ পানিতে দিয়ে চূর্ণ করার পর ছেঁকে দুধের মতো তরল অবস্থায় ৩ ঘণ্টা পর পর ছিটিয়ে দিতে হবে। দুই দিন বয়স থেকে ৩ ঘণ্টা পর পর ফিশ পেস্টের সাথে আর্টেমিয়া নপ্লিয়া এবং অপেক্ষাকৃত ছোট জুপ্লাংকটন রেণুকে খাবার হিসেবে দেয়া যায়। ট্রেতে প্রতিটি পোনার জন্য খাবার হিসেবে প্রতিবারে ৪-৫টি আর্টেমিয়া নপ্লিয়া দিতে হবে। রেণু পোনা যাতে কোনো প্রকার রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এ জন্য ট্রেতে খাবার দেয়ার আগে রাবার পাইপ দ্বারা সাইফনিং করে রেণু পোনার পরিত্যক্ত ময়লা ও উচ্ছিষ্ট খাদ্য পরিষ্কার করতে হবে। অঁতুড় পুকুরে পোনা লালন পাঙ্গাসের পোনা লালন-পালনের জন্য ৫-১০ শতাংশ আয়তনের পুকুর এবং পুকুরের পানির গভীরতা ২-৩ ফুট হলে ভালো হয়। পুকুর পোনা উৎপাদনের উপযোগী করে নেয়ার জন্য প্রথমে পুকুরে পানি সম্পূর্ণ নিষ্কাশন করে ফেলা দরকার। পানি নিষ্কাশনের পর পুকুর হতে পোনার জন্য ক্ষতিকর প্রাণী যেমন- সাপ, ব্যাঙ, ব্যাঙাচি বা অন্যান্য সব ধরনের রাক্ষুসে বা অবাঞ্ছিত মাছ ধরে ফেলতে হবে কিংবা রোটেনন নামক রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে এদের সরাতে হবে। পুকুর শুকানোর দু দিন পরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন দিয়ে পুকুরের তলদেশ দু দিন শুকাতে হবে। পরে ১০ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে। তারপরে পুকুরে পানি দিয়ে ৭ দিন পর্যন্ত রেখে দিতে হবে। এর ফলে পুকুরে মাছের খাবার জন্মাতে শুরু করবে এবং পানি বাদামি রঙ ধারণ করবে। এ অবস্থায় পুকুর ছোট পোনা ছাড়ার উপযোগী হবে। কম তাপমাত্রায় পোনা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাই খুব সকালে পোনা ছাড়া উত্তম। আঁতুড় পুকুরে সাধারণত ৫-১০ দিন বয়সের পোনা প্রতি শতাংশে ৫-১০ হাজার ছাড়া যেতে পারে। পুকুরে সরাসরি রেণু ছাড়া উচিত নয়। এতে সব পোনাই মারা যেতে পারে। তাই পোনা ছাড়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন পোনার পাত্রের তাপমাত্রা এবং পুকুরের পানির তাপমাত্রা সমান হয়। পুকুরে পোনা মজুদ করার পর প্রতিদিন পোনার মোট ওজনের দ্বিগুণ পরিমাণ খাবার সারাদিনে তিনবারে ভাগ করে সরবরাহ করতে হবে। এই খাবার শতকরা ৫০ ভাগ ফিশমিল ও ৫০ ভাগ কুঁড়া সহযোগে খাবার তৈরি করা যায়। এ ছাড়াও শতকরা ৩৫ ভাগ খৈল ও ৩৫ ভাগ কুঁড়া সহযোগে খাবার তৈরি করা যায়। পুকুরে খাবার দেয়ার পর লক্ষ রাখতে হবে যেন পুকুরে খাবার অবশিষ্ট না থাকে। খাবার অবশিষ্ট থাকলে তা পচে পানি নষ্ট করে ফেলবে এবং এতে পোনার মৃত্যুহার অনেক বেড়ে যাবে। তথ্যসূত্র: ইসরাত জাহান চৌধুরী, প্রযত্নে – ড. মো. জাহান উল্যাহ চৌধুরী, ফার্ম ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন, ব্রি, জয়দেবপুর, গাজীপুর
- Blogger Comment
- Facebook Comment
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
0 comments:
Post a Comment