লতিরাজ কচুতে ভাগ্য ফেরালেন শাহজাহান

আনোয়ার হোসেন শাহীন অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা ছিল মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়ার মো. শাহজাহানের। নিজের কোনো বসতভিটাও ছিল না তার। দিনমজুরি করে যা আয় হতো তা দিয়ে আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতেন। তবে এসব এখন অতীত। লতি রাজ কচু চাষ তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাকে দেখে ও পরামর্শ নিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গার প্রায় দেড় হাজার কৃষক কচুর আবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শাহজাহান কচু চাষ শুরু করেছিলেন। এখন তিনি জেলার সফল লতি রাজ কচু চাষি। সাড়ে চার বিঘা জমিতে কচুর চাষ করছেন তিনি। মাসিক আয় লাখ টাকা ছাড়িয়ে।

উপজেলার শ্রেষ্ঠ চাষির পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। কেবল কচু নয়, এখন মাছ ও মাছের পোনাও উৎপাদন করেন তিনি। উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় দেড় হাজার লোক শাহজাহানের কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে লতি রাজ কচুর চাষ করছেন। মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান ১২ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে যশোরের বাঘাড়পাড়া এলাকায় চলে যান। সে সময় আলমগীর হোসেন নামের স্থানীয় এক কৃষকের বাড়িতে দিনমজুরি করে দিন কাটে তার। ছয়বছর পর নিজের গ্রামে ফিরে এসে বিয়ে করে সংসার পাতেন। অভাব তখন নিত্যসঙ্গী। কী করবেন, ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কচু চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন। আগেই অভিজ্ঞতা ছিল। যশোরের বাঘারপাড়া থেকে চারা আনেন। ২০০৪ সালে নিজের দশ শতক কৃষি জমিতে লতিরাজ কচুর আবাদ শুরু করেন। লতির জন্য আলাদা কচু আবাদের কোনো ধারণাই এ এলাকার কৃষকদের ছিল না।


অনেকে ধানের জমিতে কচুর আবাদ দেখে হাসাহাসি করেন। প্রথম বছরে সব খরচ বাদ দিয়ে আয় হয় ১০ হাজার টাকা। পরেরবার স্থানীয় ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এক বিঘা জমি লিজ নিলেন। বাড়ালেন কচুর আবাদ। পরের বছর দিগুন লাভ করলেন। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সম্প্রতি আড়পাড়া গিয়ে দেখা যায়, শাহজাহান তার কৃষি শ্রমিকদের নিয়ে কচু খেত থেকে লতি সংগ্রহের কাজ দেখাশোনা করছেন। তিনি জানান, প্রথমে এক বিঘা জমি ইজারা নিয়ে চাষ করলেও বর্তমানে জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ বিঘা। এর মধ্যে নিজের জমি করেছেন আড়াই বিঘা। লতিরাজ কচু চাষে বর্তমানে তার মূলধন ৫ লাখ টাকারও বেশি।

গত বছর সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে সাড়ে সাত লাখ টাকার কচুর লতি উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি লতি পাইকারি ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তার উৎপাদিত লতি পাইকাররা চালান করেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। শাহজাহান, খেতের আইলে বিভিন্ন সবজি লাগিয়ে ও পুকুরে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করেছেন পাঁচ লাখ টাকার মতো। মাছ বিক্রি করে তার লাভ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। এ বছর ৭ থেকে ১০ লাখ টাকার কচুর লতি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার। মাছ বিক্রি করেও ৩ লাখ টাকার মতো লাভ হবে বলে তিনি ধারণা করছেন। শাহজাহান জানান, লতিরাজ কচুর চাষ করে করে তিনি আড়পাড়া বাজারে দোকান করেছেন। পাশাপাশি আড়াই একর ধানি জমিও কিনেছেন।

এ ছাড়া আধাপাকা বসতবাড়ি তৈরি করেছেন। শালিখা উপজেলার সীমাখালী এলাকার কৃষক, রতন আলী জানান, উপজেলার অনেক তরুণই শাহজাহানের দেখাদেখি লতিরাজ কচুর চাষ করে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছেন। কচু চাষে শাহজাহানের কাছ থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ নেন এলাকার চাষিরা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফ উদ্দীন আহমেদ শাহজাহান সম্পর্কে বলেন, শাহজাহান দারিদ্র্য জয় করেছেন। লেখাপড়া না জানলেও তিনি উপজেলার সবার কাছে অনুকরণীয়। এ বছর জাতীয় পুরস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় দপ্তরে তার নাম পাঠানো হবে। বেকার যুবকেরা তার মতো কাজ শুরু করলে বেকারত্ব দূর হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির জন্যও সুফল বয়ে আনবে।

--------------------------
আধুনিক পদ্ধতিতে পানি কচুর চাষ
--------------------------
পানি কচু একটি পুষ্টিকর ও উপকারী সবজি। বাংলাদেশের সর্বত্র পানি কচুর চাষ করা যায়, এরা দাড়ানো পানি সহ্য করতে পারে।

উপযোগী মাটি : মাঝারি নিচু থেকে উঁচু জমি যেখানে বৃষ্টির পানি সহজেই ধরে রাখা যায় অথবা জমে থাকে এমন জমি পানি কচু চাষের জন্য উপযোগী, পলি দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি পানি কচু চাষের জন্য উত্তম।

জাত : লতিরাজ (উফশী) ও জয়পুরহাটের স্থানীয় জাত পানি কচুর জন্য উত্তম জাত।

রোপণের সময় : আগাম ফসলের জন্য কার্তিক এবং নাবী ফসলের জন্য মধ্যম ফাল্গুন থেকে মধ্য বৈশাখে কচু লাগানো যায়।

রোপণের দূরত্ব : সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি.।

কচু রোপণের নিয়ম : পূর্ণ বয়স্ক কচুর গোড়া থেকে ছোট ছোট চারা উৎপন্ন হয়। এসব চারার মধ্যে সতেজ চারা পানি কচু চাষের জন্য বীজ চারা হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। পানি কচুর চারা কম বয়সের হতে হবে, ৪-৬টি পাতাসহ সহেজ সাকার বীজ চারা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, চারা রোপণের সময় উপরের ২/১টি পাতা বাদ দিয়ে বাকি সব পাতা ও পুরানো শিকড় কেটে ফেলতে হবে। চারা তোলার পর রোপণের দেরী হলে চারা ভিজামাটি ও ছায়ামুক্ত স্থানে রাখতে হবে। মাটি থকথকে কাদাময় করে তৈরির পর নির্ধারিত দূরত্বে ৫-৬ সেমি. গভীরে চারা রোপণ করতে হবে।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি : গোবর, টিএসপি, এমওপি সার চারা রোপণের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ২/৩ কিস্তিতে দিতে হবে। তবে ১ম কিস্তি রোপণের ২০-২৫ দিনের মধ্যেই প্রয়োগ করতে হবে।

অর্ন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা : পানি কচুর গোড়ায় সব সময় পানি জমিয়ে রাখতে হবে এবং দাঁড়ানো পানি মাঝে মাঝে নাড়াচারা করে দিতে হবে। চারা বাড়-বাড়তির জন্য মাঝে মাঝে জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। আবার নির্দিষ্ট মাত্রায় পানি দিতে হবে। দেওয়া পানি সরানো যদি ৩/৪ বার করা যায় তবে পানি কচুর ফাল্গুটি সঠিকভাবে লম্বা ও মোটা হয়।

গোড়ার চারা সরানো : কাণ্ডের গোড়ায় যে সকল চারা হবে সেগুলি তুলে ফেলতে হবে। চারা হিসেবে ব্যবহারের জন্য মাটির নিচের অংশ থেকে যে সব চারা আসবে তা থেকে ২/৩টি চারা রেখে বাকি চারা কেটে দিতে হবে।

পোকা দমন : ছোট ও কালচে লেদাপোকা পাতা খেয়ে ফেলে। এসব পোকা প্রথমত হাত দিয়ে মেরে ফেরতে হবে, সংখ্যা বেশি হলে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

রোগবালাই : কচুর পাতায় মড়ক রোগ হলে পাতার উপর বেগুনী বা বাদামী রঙের গোলাকার দাগ পড়ে। পরবর্তীতে এসব দাগ আকারে বেড়ে একত্রিত হয়ে পাতা ঝলসে যায়। পরে তা কচু ও কন্দে আক্রমণ করে। বেশি আক্রান্ত হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রিডোমিন বা ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ৩-৪ বার ¯েপ্র করতে হবে।

ফলন সংগ্রহ : চারা রোপণের ৪৫-৭৫ দিনের মধ্যেই কচুর লতি তোলা হয়। ১০-১৫ দিন পরপর লতি তোলা যায়। চারা রোপণের ১৪০-১৮০ দিনের মধ্যে পানি কচু সংগ্রহ করা যায়। গাছের উপরের কয়েকটি পাতা রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলে কাণ্ডটি পরিষ্কার করে বাজারজাত করতে হবে।


ফলন : লতি : ১.৫-২ টন/বিঘা, পাতাকচু: ৩-৫ টন।
SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment