প্যাসন ফলের চাষ

ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ও ফিলিপাইনের জনপ্রিয় প্যাসন ফলের চাষ হচ্ছে এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ রহিম বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় এ নতুন ফলের চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রাকৃতিক গুণসম্পন্ন এ ফলের শরবত খেলে মানুষের শরীরের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমার পাশাপাশি ক্লান্তিও দূর হয়। চর্মরোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। প্যাসন ফল একটি বহুবর্ষজীবী লতাজাতীয় উদ্ভিদ। সচরাচর দুই ধরনের প্যাসন ফল দেখা যায়। হলুদ প্যাসন ফল ও লাল-বেগুনি প্যাসন ফল। বাংলাদেশের দুর্গম পাহাড়ি ও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকাসহ সারা দেশে হলুদ প্যাসন ফল চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। গাইবান্ধা, মাগুরা ও পঞ্চগড় জেলায় কিছুসংখ্যক শৌখিন ফল চাষি অল্প পরিসরে প্যাসন ফলের চাষ করছেন। তারা চারা তৈরি করেও বিক্রি করছেন। এ ফলটি এরই মধ্যে একটি লাভজনক ফল হিসেবে দেশে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলটি গোলাকার থেকে ডিম্বাকৃতি। আকার লম্বায় ৪ থেকে ৭ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৪ থেকে ৬ সেন্টিমিটার। পাল্প ও জুসের রঙ হলুদ এবং মোট দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণ ১০ থেকে ১৪ শতাংশ। বছরে দুবার প্যাসন ফল পাওয়া যায়। প্রথমবার মার্চ মাসে ফুল আসে এবং জুলাই-আগস্টে ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার জুলাই-আগস্টে ফুল আসে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ফল পাওয়া যায়। গাছ লাগানোর ১৪ থেকে ২০ মাসের মধ্যেই ফল ধরে। ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সের একটি গাছ থেকে ১০০ থেকে ২০০ সংখ্যক ফল পাওয়া যায়; যার ওজন ৫ থেকে ৮ কেজি। প্যাসন ফলের চাষ পদ্ধতি বেশ সহজ। লাউ, কুমড়া, শিম ও ধুন্দল জাতীয় গাছের মতো মাটিতে চারা লাগানোর পর তা বড় হলে বাঁশের মাচা অথবা অন্য গাছে উঠিয়ে দিতে হয়।


ব্যবহার : প্যাসন ফল ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ একটি ফল। এ ফলের বীজকে আবৃত করে থাকা হলুদ রঙের জিলাটিনাস সুগন্ধিযুক্ত পাল্পকে পানিতে দ্রবীভূত করে খুব উপাদেয় শরবত প্রস্তুত করা যায়। এটিকে অন্যান্য ফলের রসের সঙ্গে মিশ্রিত করেও খাওয়া যায়। পাল্পকে প্রক্রিয়াজাত করে আইসক্রিম, জুস, স্কোয়াস, জ্যাম ও জেলি প্রস্তুত করা যায়; যা আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। বীজ ও খোসা থেকে পেকটিন এবং উচ্চমাত্রার লিনোলিক এসিডসমৃদ্ধ তেল আহরণ করা সম্ভব। ফল হিসেবেও টাটকা প্যাসন ফল ভক্ষণ করা যায়।

জাত : পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র খাগড়াছড়ির বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণা করে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হলুদ প্যাসন ফলের একটি জাত উদ্ভাবন করেন। জাতটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বারি প্যাসন ফল-১ নামে ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে। বারি প্যাসন ফল-১ এর আকার ৬.৮ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৬.৩ সেন্টিমিটার। ফলের গড় ওজন ৬৮ গ্রাম এবং প্রতিটি ফল থেকে ৩০ গ্রাম রস আহরণ করা যায়। জুসের রঙ হলুদ এবং টিএসএসর মান ১৪ ভাগ।


আবহাওয়া : প্যাসন ফল গ্রীষ্ম ও অগ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। বছরে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতযুক্ত স্থান প্যাসন ফল চাষের জন্য উপযোগী। এ ফল চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে হলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি ও ফুল আসা বাধাগ্রস্ত হয়।

বংশ বিস্তার : সাধারণত বীজ ও শাখা কলমের মাধ্যমে প্যাসন ফলের বংশ বিস্তার করা হয়।

মাটি : ৫.৫ থেকে ৭.৫ অমস্নতাযুক্ত উর্বর সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ থেকে দোআঁশ মাটি প্যাসন ফল চারে জন্য উপযোগী।
ক. বীজ দ্বারা : পাল্প থেকে বীজ আলাদা করে পানি দিয়ে ধুয়ে ছায়ায় শুকিয়ে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়। তাই এ সময়ের মধ্যে ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার দূরত্বের ১.৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় বীজ বপন করে খড় দ্বারা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ২ থেকে ৩ পাতাবিশিষ্ট চারা উৎপন্ন হলে বীজতলা থেকে চারা তুলে মাটি ও জৈব সারমিশ্রিত পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। পলিব্যাগে ৩ থেকে ৪ মাস থাকার পর ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হলে চারাগুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে মূল জমিতে রোপণ করতে হবে।
খ. শাখা কলম দ্বারা : শাখা কলমের দ্বারাও প্যাসন ফলের বংশ বিস্তার করা যায়। শাখা কলমের মাধ্যমে চারা তৈরির উপযুক্ত সময় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। এ সময় পেন্সিল আকৃতির ৩ থেকে ৪ পর্ববিশিষ্ট শাখা থেকে কলম তৈরি করা যায়। নির্বাচিত শাখার নিচের পর্ব থেকে ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার নিচে তেরসা করে কেটে নিচের পর্বসহ বীজতলার মাটিতে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে পুঁতে শাখা কলম তৈরি করা যায়। শাখা কলম রোপণের সময় এক থেকে দুটি পাতা রেখে বাকি পাতা কেটে দিতে হবে। শাখা কলমে শিকড় ও পাতা গজানোর পর চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হয়।

গর্ত তৈরি : চারা রোপণের জন্য গর্তের আকার হবে ৪৫ সেন্টিমিটার দ্ধ ৪৫ সেন্টিমিটার দ্ধ ৪৫ সেন্টিমিটার। গর্তের ওপরের ২০ সেন্টিমিটার মাটি আলাদা করে রেখে তার সঙ্গে ১০ কেজি গোবর বা পচা আবর্জনা সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি, মিশ্রিত করে ওপরের মাটি গর্তের নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে দিয়ে গর্ত ভরাট করে ৮ থেকে ১০ দিন রেখে দিতে হবে।

চারা রোপণ : বীজের চারা বা শাখা কলম বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস সময়ের মধ্যে রোপণ করতে হবে। চারা ৩ মিটার ী ৬ মিটার দূরত্বে রোপণ করতে হবে।

মাচা তৈরি : প্যাসন ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য মাচা তৈরি করার প্রয়োজন হয়। চারার গোড়ায় খুঁটি পুঁতে গাছ উঠিয়ে দিতে হয়। গাছ মাটির ওপর উঠলে গাছের অগ্রভাগ কেটে দেয়া হয়, যাতে শাখা বের হয় এবং সব মাচায় ছড়িয়ে পড়ে। মাটি থেকে মাচা পর্যন্ত গাছের কান্ডে কোনো শাখা বের হলে তা কেটে দিতে হবে। পুরনো ও মরা ডাল কেটে দেয়া উচিত। এতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। বাড়ির আশপাশে মাচা তৈরি করে বা বড় ফলের গাছে ও সবজির বেড়ায় উঠিয়ে দেয়া হয়।

সার প্রয়োগ : প্যাসন ফল গাছের বৃদ্ধি ও ফলের জন্য সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত। এক থেকে তিন বছর বয়সের গাছে প্রতি বছর ১০ কেজি পচা গোবর, ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০০ গ্রাম এমওপি, ৪ থেকে ৬ বছর বয়স্ক গাছে প্রতি বছর ১২ কেজি গোবর, ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০০ গ্রাম এমওপি সার এবং ৭ বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক গাছে প্রতি বছর ১৫ কেজি গোবর, ১ হাজার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৮০০ গ্রাম টিএসপি ও ১ হাজার ৪০০ গ্রাম এমওপি সার ফুল ও ফল আসার সময়সহ ৩ থেকে ৪ কিস্তিতে গাছের গোড়ার মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ প্রয়োগ : চারা রোপণের পর ঝরনা দ্বারা বেশ কিছু দিন পর্যন্ত সেচ দিতে হবে। সর্বোচ্চ ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকতে হবে। এজন্য খরা মৌসুমে প্যাসন ফলের গাছে সেচ দিতে হবে এবং বর্ষাকালে প্যাসন গাছের গোড়ায় যাতে পানি না জমে, সেজন্য পানি নিকাশের সুব্যবস্থা করতে হবে।

আগাছা দমন : গাছের গোড়া সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

পররাগায়ন : মৌমাছি ও বোলতা দ্বারা প্যাসন ফুল পরপরাগায়িত হয়। হলুদ প্যাসন ফুল দুপুরে উন্মোচিত হয় এবং সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়। পরপরাগায়নের ফলে উৎপাদিত ফলের ওজন, রসের পরিমাণ ও বীজের সংখ্যা বেশি থাকে। হস্ত পরাগায়নে বেশি ফলন পাওয়া যায়।

ফলধারণ : পরাগায়নের পরপরই ফলধারণ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং পরাগায়নের ২০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে ফলের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া তাপমাত্রা বেশি থাকলেও ফলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

রোগ ও পোকা দমন : হলুদ প্যাসন ফলে তেমন কোনো রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায় না। তবে রোগের মধ্যে বাদামি দাগ রোগ, গোড়া পচা রোগ ও পোকার মধ্যে ফলের মাছি, মাকড় এবং মিলিবাগের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এক ধরনের ছত্রাক দ্বারা প্যাসন ফল গাছে বাদামি দাগ রোগ দেখা দেয়। এ রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভারাল মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ৩ থেকে ৪ বার স্প্রে করতে হবে। তবে মিলিবাগ, মাকড়সা ও ফলের মাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মাছি পোকা আধা পাকা ফলের গায়ে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার ছিদ্রের জায়গায় ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে ফল পচিয়ে ফেলে।

প্রতিকার : আক্রান্ত ঝরা ফল কুড়িয়ে ধক্ষংস করতে হবে। সেঙ্ ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। ফল মার্বেলের আকার হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।

ফল সংগ্রহ : ফল সম্পূর্ণ হলুদ হলে গাছ থেকে হাত দিয়ে প্যাসন ফল সংগ্রহ করতে হবে।

ফল সংরক্ষণ : প্যাসন ফল সংগ্রহের পর কয়েকদিন রেখে দিলে চামড়া কুঁচকে যায় এবং সুগন্ধ কিছুটা নষ্ট হয়। অন্যদিকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় প্যাসন ফল খুব সহজেই ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়।

SHARE

Milan Tomic

Hi. I’m Designer of Blog Magic. I’m CEO/Founder of ThemeXpose. I’m Creative Art Director, Web Designer, UI/UX Designer, Interaction Designer, Industrial Designer, Web Developer, Business Enthusiast, StartUp Enthusiast, Speaker, Writer and Photographer. Inspired to make things looks better.

  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
  • Image
    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment